জাতীয় পতাকার মর্যাদা
২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:২৮ এএম | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:২৮ এএম

জাতীয় পতাকা একটি স্বাধীন জাতির মর্যাদা ও পরিচয়ের প্রতীক। জাতীয় পতাকার ব্যবহার স¤পর্কিত বিধিমালা (পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ফ্লাগ রুলস্ ১৯৭২) প্রায়ই লংঘিত হবার অভিযোগ পাওয়া যায়। জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে গিয়ে এর যথাযথ ব্যবহার না করা কিংবা পতাকা ব্যবহারের অনুপযুক্ত ব্যক্তির পতাকা ব্যবহারের ফলে জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করা হয়। এমনকি অতীতে দেখা গেছে, মন্ত্রিসভার সদস্যরা পর্যন্ত জাতীয় পতাকা বিধি লংঘন করেছেন। খোদ মন্ত্রিসভা বিভাগ অবহিত হয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো। অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা বিভাগকে অফিস সার্কুলার পর্যন্ত জারি করতে হয়েছিল। জাতীয় পতাকা বিধির ধারা ৬-এর ২ উপধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের ¯িপকার, কেবিনেট মন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা প্রাপ্ত ব্যক্তি, ডেপুটি ¯িপকার, চিফ হুইপ, সংসদের বিরোধী দলের নেতা, প্রতিমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশন বা কনস্যুলারের অফিস প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে। এ বিধি লংঘন করে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্যের বাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলিত করা যাবে না। তবে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (সা.), ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে, সরকার কর্তৃক বিজ্ঞাপিত অন্য যে কোন দিবসে সারা বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনসমূহ ও কনসুলার অফিসসমূহে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হবে। তবে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে) ও জাতীয় শোক দিবস এবং সরকার ঘোষিত অন্য যে কোনো দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। বাংলাদেশের পতাকা সকল কর্ম দিবসে সকল গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন এবং অফিসে, (যথা রাষ্ট্রপতির ভবন, সংসদ ভবন প্রভৃতি), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সকল মন্ত্রণালয় এবং সচিবালয় ভবনসমূহ, হাইকোর্ট, জেলা ও দায়রা আদালত ভবন, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক/ কালেক্টরদের কার্যালয়, উপজেলা/ জেলা পরিষদ কার্যালয়, কেন্দ্রীয় এবং জেলা কারাগারসমূহ, থানা, কাস্টম পোস্টসমূহ এবং সরকার সময়ে সময়ে অন্য যে সমস্ত ভবন বিজ্ঞাপিত করবেন সেখানে উত্তোলন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি তাঁর মটর গাড়ি, নৌযান এবং বিমানে পতাকা উত্তোলনের প্রাধিকার রাখেন। এছাড়া আরো যে সকল ব্যক্তি তাঁদের মটর গাড়ি ও নৌযানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের প্রাধিকার রাখেন তারা হলেন: (ক) উপরাষ্ট্রপতি; (খ) প্রধানমন্ত্রী; (গ) ¯িপকার; (ঘ) কেবিনেট মন্ত্রীগণ, (ঙ) কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ; (চ) জাতীয় সংদের ডেপুটি ¯িপকার; (ছ) চীফ হুইপ; (জ) সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা; (ঝ) বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশন/ কনসুলার অফিসের প্রধানগণ, (ঞ) তবে প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ শুধুমাত্র রাজধানীর বাইরে দেশের ভেতরে বা বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাঁদের মটরগাড়ি এবং নৌযানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের প্রাধিকার রাখেন। রাজধানীর অভ্যন্তরে পারবেন না। উপরের ক্ষেত্রসমূহে সংশ্লিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিত্ব যখন গাড়িতে বা নৌযানে থাকবেন না তখন তথায় পতাকা উত্তোলন করা যাবে না।
অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় পতাকা বিধি লংঘন করে সরকারের উপমন্ত্রী ও অনেক সচিবের বাসভবনে নিয়মিতভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। নিয়ম না জানার কারণে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাসভবনে পর্যন্ত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। পরর্বর্তীতে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ স¤পর্কে অবহিত হয়ে বিগত সরকারের আমলে এক অফিস সার্কুলারে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বন্ধ করে দেয়। মন্ত্রিপরিষদের সার্কুলারে বলা হয়েছিল, ‘লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, জাতীয় পতাকা বিধি ১৯৭২-এর ৬ (২) নং বিধি লংঘন করে কোনো কোনো সরকারি বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে এবং জাতীয় পতাকা বিধি বহির্ভূতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।’ জাতীয় পতাকা বিধি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় পতাকার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় পতাকার সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা। সুতরাং জাতীয় পতাকা বিধি সঠিকভাবে পালন করা উচিত সকল সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রিদের একান্ত সচিব বরাবরে বিতরণকৃত এ সার্কুলারে জাতীয় পতাকার যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলকে জাতীয় পতাকা বিধি, ১৯৭২ সঠিকভাবে প্রতিপালন করা জরুরী জানানো হয়েছিল। দীর্ঘ দিনের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙে বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কামান আর মর্টারের গোলাকে প্রতিহত করে এক সাগর রক্তের স্রোত সাঁতরিয়ে এদেশবাসী উত্তোলন করেছে রক্তের স্মৃতিবাহী এ ন্যায়ের পতাকা। তাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এ দেশের লক্ষ লক্ষ প্রিয়জন হারানো গণমানুষের জন্যে একটি সান্তনা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রত্যেকটি স্বাধীন জাতির পৃথক পৃথক জাতীয় পতাকা রয়েছে। জাতীয় পতাকাগুলো যেমন প্রতিটি দেশ ও জাতির নিজ নিজ সংস্কৃতি, সভ্যতা, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে আমাদের দেশের পতাকাও আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, আশা, আকাক্সক্ষা এবং আদর্শকে রূপ দিয়েছে। যে জাতি জাতীয় পতাকার মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করতে বেশি জানে সে জাতির পতন অসম্ভব। জাতীয় পতাকার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা প্রতিটি নাগরিকের প্রাণের ও ঈমানের দাবি। এ পতাকার সম্মান রক্ষার্থে এদেশবাসী দেখিয়েছে ত্যাগের এক চরম পরাকাষ্ঠা, এ ত্যাগই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে স্ব-গৌরবে খাঁড়া করেছে। যুদ্ধের সময় হানাদাররা প্রথমে অধিকৃত অঞ্চলের জাতীয় পতাকাকেই বিলুপ্ত করে স্বীয় জাতীয় পতাকা উড়ায়। এর থেকেই জাতীয় পতাকার গুরুত্ব কতটুকু লক্ষ্যণীয়। তাই জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা একটি সচেতন জাতি হিসেবে আমাদের অজানা থাকার কোন যৌক্তিকতাই নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন তো দূরের কথা বরং রীতিমত অবজ্ঞা, অবহেলা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করা মানেই হলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা করা। এটা রাষ্ট্রদ্রোহীতার শামিল। অত্যন্ত ক্ষোভ ও আক্ষেপের সাথে বলতে হয় আমাদের দেশের জাতীয় পতাকাগুলো অধিকাংশই ভুল নিয়মে প্রস্তুত। এটা জাতীয় পতাকার প্রতি উপহাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। কোন বিদেশিকে এদেশে এসে এসব বিচিত্র ও রকমারী জাতীয় পতাকাসমূহ দেখে অবাক হতে হয়। রং বেরং (গাঢ় এবং হালকা রং) এর পতাকাসমূহ দেখে মনে হয় যেন দেশটির মানুষ জাতীয় পতাকার মর্যাদা স¤পর্কে স¤পূর্ণ অসচেতন। শিক্ষিতদের মধ্যেও পতাকা বিধি এবং জাতীয় পতাকার অংকন পদ্ধতি না জানার কারণেই এদেশের জাতীয় পতাকার এত রকমারিত্ব। লাল বৃত্তটিও ইচ্ছামত আঁকা হয়। অনেক সময় ছেড়া, পুরানো ও রং চটা (ডিসকালার) পতাকাও দৃষ্টির গোচরে আসে। জাতীয় পতাকা অর্ধ নমিত করার নিয়ম না জানায় ইচ্ছামত পতাকা টাঙ্গানো হয়ে থাকে। এতে যার সম্মানার্থে পতাকা অর্ধ নমিত করা হয়েছে তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়তো বটেই বরং জাতীয় পতাকাও হয় অপমানের শিকার। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার সময় কিংবা নামানোর সময় উপস্থিত দর্শকদেরকে অবশ্যই নিঃশব্দে সোজা দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, কোন অনুষ্ঠানে যখন জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় তখন অজ্ঞ দর্শকরা এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বরঞ্চ হই-হুল্লুড় শুরু করে দেয়। এইভাবে পদে পদে জাতীয় পতাকাকে আমরা অমর্যাদা করে চলেছি।
জাতীয় জীবনে জাতীয় পতাকার মর্যাদা অপরিসীম ও সর্বোচ্চ। এটা আমাদেরকে আত্ম প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত জাতিতে পরিণত করার প্রেরণা যোগায়। এ-পতাকা অর্জনে এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে যে বিশ্বের কোন দেশ বা জাতিকে এত মূল্য দিতে হয়নি। সুতরাং, আমরা অনেক মূল্যে যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং আমাদের হাতে যার গৌরব ও মর্যাদা রক্ষার ভার, আমরা বেঁচে থাকতে সে জাতীয় পতাকার পূর্ণ গৌরব বজিয়ে রাখবোই ইনশাআল্লাহ।
লেখক: আইনবিদ, মানবাধিকার ও
সুশাসন কর্মী, কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ভূমিকম্পে ১৭০ প্রিয়জন হারালেন এক ইমাম

চট্টগ্রামে জোড়া খুন, ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রীকে আসামি করে মামলা

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বাস-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ৭

হাসপাতালে ভর্তি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, আছেন নিবিড় পর্যবেক্ষণে

ইরান হামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে আকাশসীমা দেবে না গালফ দেশগুলো

চাটমোহরে জমি নিয়ে বিরোধ, দুই পক্ষের সংঘর্ষে নারীসহ আহত ৩০

আজ কেরানীগঞ্জের ভয়াল গণহত্যা দিবস ২ এপ্রিল

এবার জামায়াত নেতা ড. মাসুদের জন্য ভোট চাইলেন রুমিন ফারহানা!

আজ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস, আহনাফের জয়ের গল্প

সিরিয়াজুড়ে ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিভ্রাট, জনজীবন বিপর্যস্ত

ঢাকার বাতাস আজও ‘অস্বাস্থ্যকর’

তেল-গ্যাসের নতুন খনি আবিষ্কার দক্ষিন চীন সাগরে

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৪২ ফিলিস্তিনি

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে কেউ পুনর্বাসিত করতে পারবে না- আবদুল হান্নান মাসউদ

গুপ্ত রাজনীতি যারা করে, তাদের প্রতি শুভ কামনা নেই : ছাত্রদল সভাপতি

পাকিস্তানকে কঠিন লক্ষ্য দিল নিউজিল্যান্ড

দক্ষিণ আফ্রিকার কোচের পদত্যাগ

পহেলা এপ্রিল থেকে শুরু হলো সুন্দরবনের মধু আহরণ

বাচ্চু মোল্লা অপ্রীতিকর এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হবেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক : এ্যানি

সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় সিনেমা হলে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ